Wednesday, July 4, 2012

যে কটা দিন তুমি ছিলে পাশে...

যে কটা দিন তুমি ছিলে পাশে কেটেছিল নৌকার পালে চোখ রেখে......

পার্কিং থেকে গাড়ীটা বের করতে করতে এভাবেই মোবাইলটা বেজে উঠল। গাড়ীটা একটু সাইড করে মোবাইলটা তোলে দেখলামগদাই কলিং।

-হ্যালো।

-কি রে কথায় তুই?

-এই বের হচ্ছি।

-এখনও তুই শিলচরে?

-আর বলিস না, কালকে ফেসবুকে একটা আড্ডা জমে গেছিল, তাই ঘুমোতে দেরি হয়ে গেল। ৯টার সময় উঠেছি। সবাই কি এসে গেছে?

-অল-মোস্ট। তুই তাড়াতাড়ি আয়।

-হ্যাঁ হ্যাঁ, আসছি; বাই।

মোবাইলটা পাশে সরিয়ে গাড়ীটা স্টার্ট দিলাম আর মিউজিক প্লেয়ারটাও অন করে দিলাম। অঞ্জন দত্ত গেয়ে উঠলেনআমি বৃষ্টি দেখেছি…

আজ মনটা কেমন যেন একটা অদ্ভুত অভিনয় করছে। ১৪ বৎসর পর আজ আবার আমার স্কুলে যাচ্ছি। যেন রামচন্দ্রের বনবাস যাপনের পর অযোধ্যা প্রত্যাবর্তন। ইস্, কার সাথে কি মিলচ্ছি! তবে সত্যি, আজ একটা অদ্ভুত আবেগ কাজ করছে অন্তরে। আজ আমাদের স্কুলের স্বর্ণ জয়ন্তী বর্ষ উৎযাপন অনুষ্ঠান। তাই স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদেরও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। গত সপ্তাহেই শিশির স্যার নিজে আমাকে ফোন করে আমন্ত্রণ জানালেন। তিনি এখন প্রধান শিক্ষক। স্যার আমাকে সবসময়ই খুব স্নেহ করতেন। তাই উনার কথা রাখতেই এই ব্যস্ত কর্মজীবনের মধ্যেও একদিনের ছুটি বের করে নিয়েছি। নাহলে ঘণ্টার দূরত্ব অতিক্রম করে যে শহর ছেড়ে এসেছিলাম, ১৪ বৎসরেও সেই শহরে আর একটিবার ফিরে যেতে পারিনি।

গদাই বলছিল আমাদের ক্লাসের প্রায় সবাই নাকি আসছে। গদাই আমার স্কুল-ফ্রেন্ড, যাকে স্কুলের বাইরের দুনিয়ায় প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। হঠাৎ মাস আগে কোথা থেকে জানি না আমার নাম্বারটা জোগাড় করে ফোন করল। ওর সাথে সেদিনের ১০ মিনিটের কথায় স্কুলের ১০ বৎসর যেন ছবি হয়ে ভেসে উঠেছিল। আজ আবার সবার সাথে দেখা হবে।

জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি। কিন্তু, স্কুলের সেই দশটি বছর আজও মিস্ করি। মিস্ করি সেই বন্ধুদের, সেই ফেলে আসা সময়। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল রঞ্জন, পড়াশুনায় ততটা ভালো ছিল না। মেট্রিকের পর আমি যখন শিলচর চলে আসি, সে বদরপুরেই থেকে যায়। সময় বেস্ট-ফ্রেন্ডও পালটে দেয়। এখন একটা চিট্ফান্ডে কাজ করছে। মধ্যে মধ্যে কথা হয়। এমন অনেক বন্ধুই সময়ের সাথে সাথে দূর হয়ে গেছে। জানিনা সবাইকে এখন চিনতেও পারব কি না! মনে হয় সুভাসের কথা, কিভাবে কথা বলতে বলতে আটকে যেত। একবার একটা মেয়েকে প্রোপস্‌ করতে গিয়ে বলা শেষ হওয়ার আগেই মেয়েটা চলে গিয়েছিল। যখন ক্লাস ১০এ ছিলাম, আমাদের ক্লাসরুমটা থেকে মেয়েদের ক্লাসরুমটা সোজা দেখা যেত। যদি একটা মেয়ে ফিরে একবার দেখে নিত, তবে সে ছিল এক বিরাট প্রাপ্তি।

হ্যাঁ। আমিও একজনকে দেখতাম। মিষ্টি হাসি ছিল যার, দেখতে একদম প্রীতি জিণ্টা মনে হত। উত্তরে সেও দেখত, লাজুক চোখে। ১সেকেন্ডের চোখে চোখ, সেকেন্ডের মুচকি হাসি, এইতো ছিল ভালোবাসা। পিয়ালী সবসময়ই খুব চঞ্চল ছিল। আর সেই চঞ্চলতাই আমার ভালো লাগত। ক্লাস ১ এ সে প্রথম এসেছিল, আর আমি দ্বিতীয়। তখন ও ছিল আমার প্রধান শত্রু। তারপর যখন ক্লাস প্রথম বুঝতে পেরেছিলাম প্রেম নামক কিচ্ছু একটা হয়, স্থির করেছিলাম ক্লাসের সব থেকে সুন্দর মেয়ে পিয়ালীই হবে আমার প্রেমিকা। উঠার পর শর্মিষ্ঠা বলেছিল, পিয়লিও নাকি আমায় পছন্দ করে। তারপর জল খাওয়ার বাহানায় কতবার যে ওদের ক্লাসরুমের পাশ দিয়ে যেতাম। যখন বৃত্তি পরীক্ষার কোচিং চলছিল, তখন একদিন হঠাৎ করে পিয়ালী উঠে এসে আমার ব্যাগ থেকে একটা কলম নিয়ে গিয়েছিল। আর তা দেখে কুণাল বলে দিয়েছিলনে নে, রাজীবের সব জিনিসে তো তোরই একমাত্র অধিকার। বেচারা কুণাল, সেদিন যা পিটুনি খেয়েছিল ওর হাতে। এই সব ঘটনা ওকে আমার মনের আরও পাশে নিয়ে এসেছিল। তবু জানি না কেন ক্লাস এর পরীক্ষার পর যখন স্বপ্নার হাতে পিয়ালীর জন্য প্রথম প্রেম পত্রটা পাঠিয়েছিলাম, উত্তরটানাএসেছিল। ভার হৃদয়ে তাই নববর্ষের গ্রিটিংসে লিখেছিলামইউ ব্রোক মাই হার্ট। আর পরদিন বিকেলেই আবার স্বপ্নার হাতে আরেকটা গ্রিটিংস এলোআই এম্‌ অলউয়েস্‌ ইয়রস্‌। জানুয়ারি মাসেও সেদিন বৃষ্টি পড়েছিল, আর আমি সেই বৃষ্টিকে প্রাণ ভরে ছুঁয়ে দেখেছিলাম। তারপর ভালোবাসা চলেছিল - একটু দেখা, একটু হাসি, আর অনেকগুলো প্রেমপত্রের মধ্য দিয়ে।

দেখতে দেখতে একটি বৎসর চলে গেল। মেট্রিক পাশ করে আমি চলে এলাম শিলচরে, আর চলে গেল শিলিগুড়ি। সেদিন থেকে আজ অব্ধি আর দেখা হয়নি আমাদেরক্যারিয়ারের যুদ্ধে হারিয়ে গিয়েছিল আমাদের দুজনেরই প্রথম ভালোবাসা।

এসব ভাবতে ভাবতেই আমার গাড়ীটা স্কুলের প্রায় পাশে চলে এলো। সেই পুরনো পরিচিত গলির মাঝে আমার গাড়ীর জন্যে একটা পার্কিং খোজে নিলাম। গদাই বলছিল আজ পিয়ালিও নাকি আসছে! কথাটা শুনে আঁতকে উঠেছিলাম। হয়ত এজন্যেই অনুভূতিগুলো কেমন অদ্ভুত লাগছে। তবে দেখা হলে কি বলা উচিত?/আমি কি আগে কথা বলব?/ না দূরে দুরেই থাকব। উফ্, আমি এত ভাবছি কেন? তবে কি আমার এখনও ওর জন্যে......

যে কটা দিন তুমি ছিলে পাশে কেটেছিল নৌকার পালে চোখ রেখে......

ফোনটা আবার বেজে উঠল, দেখলামহোম মিনিস্টার কলিং

-হ্যালো

-কি গো, পৌঁছে গেছো?

-হ্যাঁ, এই জাস্ট গাড়ী থেকে বের হচ্ছি।

-ঠিক আছে, দেখ! পুরনো বন্ধুদের পেয়ে ভুলে যেয় না, বাড়ীতে বউ অপেক্ষা করছে...

-তোমাকে কি ভোলতে পারব সোনা, চিন্তা কর না, তাড়াতাড়ি চলে আসব, বাই

-বাই।

ভাবনার আকাশ থেকে বাস্তবের মাটিতে নিমেষেই ফিরে এলাম। হাসিমুখেই পা বাড়ালাম আমার প্রিয় স্কুলের গেটের ভিতরে।

No comments:

Post a Comment