বেলা এখন বিকেল 4:30 । ব্যাগটা গুছানো প্রায় শেষ। একটু পরেই বেরিয়ে পরতে হবে I.S.B.T. উদ্দ্যশ্যে। দুই সপ্তাহ পর ফিরে যাব আমার প্রানের শহর শিলচরে। গত ১৫ দিন এখানে অনেক আনন্দ হয়েছে। কিন্তু ঘরের ডালভাতের স্বাদ আর নিজের বিছানায় শোবার আনন্দ আর কোথাও নেই। সে যাই হোক, এই মুহুর্ত্তে আমি গত ১৫ দিনের নস্টালজিয়ায় ভোগছি। জীবনের প্রথম চাকরির প্রথম ট্রেনিং – বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা অচেনা চেহারাগুলো কি আস্বাভাবিকভাবে শুধু ১৫দিনেই যেন ছোটবেলার সাথী মনে হচ্ছে। এইসব ভাবতে ভাবতেই রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। কিছু বন্ধুরা আগেই বেরিয়ে পড়েছে। বাকিরা কাল যাবে। এই বেলায় শুধু আমিই যাচ্ছি। একজন একজন করে সবাই কে গুডবাই বলে বেরিয়ে এসেছি। শুধু তানিয়াকে কোঁথাও খুঁজে পেলাম না। এই ক’দিনে অনেক বন্ধু হয়েছে। কিন্তু, তানিয়ার কথা বিশেষভাবে মনে থাকবে। আমরা রোজ ক্লাসে একসাথে বসতাম। বিকেলবেলাও যখন দল বেঁধে রোজ গুয়াহাটি দর্শনে বেরোতাম, তখনও সিটি বাসে আমাদের দুজনের একসাথে সিট্ রীজার্ভ থাকত। আজও সিটিবাসে উঠে বসেছি। কিন্তু, পাশের সিট্ আর রীজার্ভ নেই। সায়ন, রাজেষ, পায়েল ওরা আমাদের নিয়ে সবসময় ঠাট্টা করত। বলত আমাদের নাকি একসাথে খুব মানায়। তানিয়া তা শুনে হেসে মাথা নামিয়ে দিত, আর ওদের ঠাট্টা আরও বেড়ে যেত। আমার মনেও তখন কেমন যেন একটা শুরশুরি অনুভব হত। এইসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে বাসটা I.S.B.T. এসে গেল, বুঝতেই পারি নি। যাই হোক, সিটিবাস থেকে নেমে সোজা কাউন্টারে গিয়ে নিজের নাইটসুপারের খুঁজ নিলাম। সামনেই দাঁড়ানো ছিলো। তাই উঠে গিয়ে সিটে ব্যাগটা রেখে দিলাম। ২X১ বাস, ৩নং সিট- জানালার পাশে, আমার পছন্দের সিট। হাতে এখনও আঁধ ঘণ্টার মত সময় আছে। তাই নিচে নেমে এলাম। হঠাৎ মনে হল, একটা চেনা চেহারা এদিক ওদিক কিছু খোঁজছে। একটু সামনে গিয়ে দেখি এতো তানিয়া। পরনে আকাশী টপ্, কালকেই বিগবাজার থেকে কিনে ওকে গিফট্ করেছিলাম। দারুন মানিয়েছে ওকে। আমি একটু আগে বারতেই ও আমাকে দেখে ফেললো। আমার দিকে এসে বলল- যাওয়ার আগে একবার দেখা করার জন্যও অপেক্ষা করলে না।
- তোমাকে তো অনেক খোঁজেছি, কোথায় ছিলে?
- তোমাকে কি এমনি খালি হাতে যেতে দেব! তোমার জন্য একটা গীফট্ নিতে গিয়েছিলাম, আর তুমি একটুও অপেক্ষা করতে পারলে না, স্টুপিড্।
এই বলে একটা প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে হাতটা জরিয়ে ধরল। কিছুক্ষন দুজনেই চুপচাপ হয়ে রইলাম। কিছু অজানা অনুভুতি যেন চারিদিকে জড়িয়ে ধড়েছে। ভালোবাসার মিষ্টি গন্ধ যেন বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। ধ্যানভগ্ন ঘটলো নাইটসুপারের হর্নের আওয়াজে। সুপার যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। তানিয়াও হাতটা ছেরে দিল। আমি বললাম – তুমি এখন ঘরে যাও। এখান থেকে ভাঙ্গাগড় যেতে সময়ও লাগবে। সাবধানে যেও।
তানিয়া আর কিছুই বলল না। শুধু শেষবারে মত একবার আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। আর আমিও বাসে উঠে বসে পরলাম। হাতের গীফট্টা আর না দেখেই ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলাম।
পরের দিন সকাল ১০টা। জাস্ট ঘরে এসে ঢুকেছি। গুয়াহাটি-শিলচর রাস্তা এমনিতেই আদীমযুগের যাতায়াত ব্যবস্থাকেও হার মানিয়ে দেয়। রাতের ধকল কাটাতে তাই আগে স্নানটা সেরে নিলাম। মা চা এনে দিলেন। চাএ চুমুক দিতে দিতে চোঁখ পড়ল যুগশঙ্খ পত্রিকায়, আর নিমেষে যেন আমার পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে উঠলো-“কাল ভাঙ্গাগড় এলাকায় এক ভয়ঙ্কর বোমা বিষ্ফোরনে একজন নিহত, আর অনেক আহত হয়েছেন। নিহত তরুনীর নাম তানিয়া চৌধুরী”। খবরটা আর পড়ার আগেই কাগজটা হাত থেকে পরে গেল আর অজান্তেই চোঁখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। অশ্রুসজল চোখে ভেসে উঠল তানিয়ার মুখ, আর মনে পড়ল কালকের গীফট্ এর কথা। এখনও খোলা হয় নি। ব্যাগ থেকে প্যাকেট্টা বের করে রেপারটা খুলে দেখি একটা গানের সিডি। তার উপরে বড় করে লেখা – “আমার ভিতর বাহিরে অন্তর অন্তরে আছো তুমি, হৃদয় জুড়ে”
No comments:
Post a Comment