Monday, December 31, 2012

বার্থ ডে

পাওয়ার পয়েন্টটা মোটামোটি শেষ। এমাসের সেলসের টার্গেট ১২৩% এচিভ হয়েছে। তাই টেনশনটা কম। নাহলে গত মাসের মত আবার বসের রুদ্ররূপ দেখতে হত। রেগে গেলে বস্ যে কি বলে হয়ত নিজেও বুঝতে পারে না। আসলে এই সমস্যাটা সমস্ত সেলস এন্ড মার্কেটিং সেক্টরের। অনুপমের গানটা এখানে খুব মানায় – “যতক্ষণ তুমি জিতছ, প্রত্যেকটা মানুষ তোমার সাথে। তুমি একবার হেরে যাও, আর কেউ নেই তোমার পাশে।” আসলে এই লাইনটা জীবনের সব যায়গায়ই মানায়, কারণ জীবনটাও আসলে যে একটা সেলস এন্ড মার্কেটিং এর চাকরীর মতই। দেয়াল ঘড়ির কাঁটা রাত আঁটটা বাজার সূচনা দিল। তখনই সুজয় হাঁফতে হাঁফতে আমার কেবিনে এসে ঢুকল।
-        কি ব্যাপার সুজয়? এভাবে হাফছিস কেন?
-        স্যার, একটা প্রবলেম হয়ে গেছে। আপনি তাড়াতাড়ি ক্যণ্টিনে আসুন।
-        কি হয়েছে? খুলে বল।
-        আপনি আগে আসুন স্যার, আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন।
তাড়াতাড়ি করে পাওয়ার পয়েন্টটাকে সেভ করে রুম থেকে বেরিয়ে পরলাম। সুজয় আগে আগে ছুটছে। ক্যান্টিনটা আমাদের উপরের তলায়। যাওয়ার সময় দেখলাম কেউ নিজের ডেস্কে নেই। সাধারণত নয়টার আগে কেউ অফিস থেকে বের হতেই পারে না। বুঝলাম সব ক্যান্টিনেই জমায়েত হয়েছে। সুজয় দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল
-        স্যার, আপনি আগে যান।
মনে একটা সংশয় নিয়ে দরজাটা খোললাম। আমার সংশয় সেকেন্ডের মধ্যে সারপ্রাইসে বদল হয়ে গেল যখন সবাই একসাথে গেয়ে উঠল – “হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার স্যার, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ”।
এতক্ষণে বোঝতে পারলাম কেন বিকেল থেকে অফিসটা এত ফাঁকা লাগছিল। পাওয়ার পয়েন্টের চক্করে তখন গা লাগাই নি। এখন বুঝতে পারছি যে আসলে সবাই মিলে এখানে আমার সারপ্রাইস বার্থডে পার্টীর প্রস্তুতি করছিল।
-        স্যার, এবার কেকটা কেটে ফেলুন। আর সহ্য হচ্ছে না। (বলল পেটুক সুমন)
-        হ্যাঁ হ্যাঁ, চল সবাই মিলে কাটব এন্ড থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ্ ফর দিস সারপ্রাইস।
এই বলে কেকটা কেটে পার্টি স্টার্ট হল। সবাই গানে নাচে মেতে উঠেছে। আমাকেও এক দুবার পা মেলাতে হল। তবে এখন আর বয়সের কাছে হার মানতে হয়। গত রাতেই ৪৯টি বছর কাটিয়ে ফেললাম এই পৃথিবীতে। আজ তা উৎযাপনও হয়ে গেল।
এই ফেলে আসা ৪৯টি বছরে অনেক কিছু পেয়েছি- টাকা, প্রোমোশন, সম্মান, তিরস্কার, বাড়ী, গাড়ী, টার্গেট, বাজেট, ধূর্ততা, ভালোবাসা… ভালোবাসা!! না, সেটা নেই। যা পেয়েছিলাম, তাও এই কেরিয়ারের দৌড়ে কখন যে হারিয়ে দিলাম, বুঝতেও পারিনি। যখন বুঝেছি তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। আজও মনে পরে সেই রাতের কথা। সেদিন ছিল আমার ৩৩তম জন্মদিন। শর্মিষ্ঠা আমার জন্যে এমনই একটা পার্টীর প্রস্তুতি করে রেখেছিল। শর্মিষ্ঠা আমার স্ত্রী। আমি কথাও দিয়েছিলাম যে সেই সন্ধ্যাটা পুরোটাই আমি আমার পরিবারের সাথে কাটাব। কিন্তু আমি কথা রাখতে পারি নি। সেলসের টার্গেট এচিভ করার নেশায় আমি সব ভুলে গিয়েছিলাম। রাত ১০টার সময় শর্মিষ্ঠা যখন আমাকে ফোন করল, আমি তখন আরেক শহরে ডিসট্রিবিউটারের সাথে মিটিংএ। দুদিন পর যখন বাড়ী ফিরলাম, ফাঁকা বাড়ীতে শুধু একটা নোট্ রাখা ছিল –
“আমি আর আমার ছেলে তোমার বাড়ী এবং তোমার জীবন থেকে চলে যাচ্ছি। ভালো থেকো। ইতি, শর্মিষ্ঠা”
হঠাৎ মনে হয়েছিল চারপাশের সব কিছু যেন ছিটকে যাচ্ছে, আর আমি পড়ে আছি একা বিশাল মরুভূমির মধ্যে। তারপর অনেক চেষ্টা করেছি স্ত্রী সন্তানকে ফিরিয়ে আনতে। কিন্তু শর্মিষ্ঠার একটাই উত্তর ছিল –
“তোমার প্রথম ভালোবাসা তোমার চাকরী, দ্বিতীয় হয়ে আমি আর থাকতে পারব না”।
শুধু এটুকুই নয়, আজ ১৬ বছর হয়ে গেল; শর্মিষ্ঠা আমাকে আমার ছেলের মুখটুকুও দেখতে দেয়নি। সেই এক বছর তিন মাসের ছেলেকে শেষ দেখেছিলাম, আজ সে কেমন দেখতে হল তাও জানি না। এসব ভাবতে ভাবতে দু ফোটা জল চোখের সীমানা ডিঙিয়ে কখন যে বয়ে পড়ল, বুঝতেও পারি নি।
আর ভালো লাগছিল না এইখানে। তাই সবাইকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। গাড়ীতে ঢোকার সময় মোবাইলটা বেজে উঠল।
-        হ্যালো
-        (নীরবতা...)
-        হ্যালো। কে বলছেন?
-        মেনি মেনি হেপি রিটার্নস্ অফ দা ডে।
-        কে! শর্মিষ্ঠা?
-        গলাটা ভোলনি মনে হচ্ছে।
-        কিভাবে ভুলব! এই আওয়াজটা যে আজও আমার কাছে সব থেকে মিষ্টি।
-        খুব, খুব মনে পড়ছিল তোমার কথা। আজ সকাল থেকেই। তাই ফোন না করে আর পারলাম না।
-        শর্মিষ্ঠা! আমরা কি আবার একটা শুরু করতে পারিনা।
-        লাভ কি। তুমি তোমার কাজ নিয়ে আবার ব্যস্ত হয়ে পড়বে।
-        না শর্মিষ্ঠা। ঢের হয়েছে। আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। আমি টাকার পেছনে ছুটছিলাম। ভেবেছিলাম টাকা দিয়ে তোমাদের সব সুখ দিতে পারব। আজ আমার কাছে অনেক টাকা আছে, কিন্তু কাউকে একটুও সুখ দিতে পারি নি। শুধু ছুটেই যাচ্ছি, অজানা গন্তব্যের খোঁজে। আমি আর পারছি না। তাই রিটায়ার্মেন্ট নিচ্ছি। বস্ এর সাথে আগেই কথা বলে রেখেছি। আমার এই নতুন জীবনে আমার পরিবারকে কি আবার কাছে ফিরে পাব না?
-        তোমার কাজটা কখনই আমার প্রবলেম ছিল না। প্রবলেমটা ছিল কাজটা তোমার কাছে তোমার পরিবারের চেয়ে বেশী প্রাধান্য পাচ্ছিল। এখন হয়ত প্রাধান্যটা আবার ফিরে পাওয়া যাবে। আমরা আসছি, কালকেই।
-        না, আমি আসছি। তোমাদের ফিরিয়ে আনতে।
এই বলে ফোনটা কেটে গাড়ীটা স্টার্ট দিলাম। এক দমকা হাওয়া সেকেন্ডে ভিতরটাকে শীতল করে দিয়ে গেল। এফ এম টা অন্ করতেই গান বেজে উঠল –
“আমার ভিন দেশী তারা, আমার রাতেরই আকাশে, তুমি বাজালে একতারা, আমার চিলেকোঠার পাশে...”

এক ‘টুকরো’ ভালোবাসা

বেলা এখন বিকেল 4:30 । ব্যাগটা গুছানো প্রায় শেষ। একটু পরেই বেরিয়ে পরতে হবে I.S.B.T. উদ্দ্যশ্যে। দুই সপ্তাহ পর ফিরে যাব আমার প্রানের শহর শিলচরে। গত ১৫ দিন এখানে অনেক আনন্দ হয়েছে। কিন্তু ঘরের ডালভাতের স্বাদ আর নিজের বিছানায় শোবার আনন্দ আর কোথাও নেই। সে যাই হোক, এই মুহুর্ত্তে আমি গত ১৫ দিনের নস্টালজিয়ায় ভোগছি। জীবনের প্রথম চাকরির প্রথম ট্রেনিং বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা অচেনা চেহারাগুলো কি আস্বাভাবিকভাবে শুধু ১৫দিনেই যেন ছোটবেলার সাথী মনে হচ্ছে। এইসব ভাবতে ভাবতেই রুম থেকে বেরিয়ে এলাম। কিছু বন্ধুরা আগেই বেরিয়ে পড়েছে। বাকিরা কাল যাবে। এই বেলায় শুধু আমিই যাচ্ছি। একজন একজন করে সবাই কে গুডবাই বলে বেরিয়ে এসেছি। শুধু তানিয়াকে কোঁথাও খুঁজে পেলাম না। এই কদিনে অনেক বন্ধু হয়েছে। কিন্তু, তানিয়ার কথা বিশেষভাবে মনে থাকবে। আমরা রোজ ক্লাসে একসাথে বসতাম। বিকেলবেলাও যখন দল বেঁধে রোজ গুয়াহাটি দর্শনে বেরোতাম, তখনও সিটি বাসে আমাদের দুজনের একসাথে সিট্‌ রীজার্ভ থাকত। আজও সিটিবাসে উঠে বসেছি। কিন্তু, পাশের সিট্‌ আর রীজার্ভ নেই। সায়ন, রাজেষ, পায়েল ওরা আমাদের নিয়ে সবসময় ঠাট্টা করত। বলত আমাদের নাকি একসাথে খুব মানায়। তানিয়া তা শুনে হেসে মাথা নামিয়ে দিত, আর ওদের ঠাট্টা আরও বেড়ে যেত। আমার মনেও তখন কেমন যেন একটা শুরশুরি অনুভব হত। এইসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে বাসটা I.S.B.T. এসে গেল, বুঝতেই পারি নি। যাই হোক, সিটিবাস থেকে নেমে সোজা কাউন্টারে গিয়ে নিজের নাইটসুপারের খুঁজ নিলাম। সামনেই দাঁড়ানো ছিলো। তাই উঠে গিয়ে সিটে ব্যাগটা রেখে দিলাম। ২X১ বাস, ৩নং সিট- জানালার পাশে, আমার পছন্দের সিট। হাতে এখনও আঁধ ঘণ্টার মত সময় আছে। তাই নিচে নেমে এলাম। হঠাৎ মনে হল, একটা চেনা চেহারা এদিক ওদিক কিছু খোঁজছে। একটু সামনে গিয়ে দেখি এতো তানিয়া। পরনে আকাশী টপ্‌, কালকেই বিগবাজার থেকে কিনে ওকে গিফট্‌ করেছিলাম। দারুন মানিয়েছে ওকে। আমি একটু আগে বারতেই ও আমাকে দেখে ফেললো। আমার দিকে এসে বলল- যাওয়ার আগে একবার দেখা করার জন্যও অপেক্ষা করলে না।
-     তোমাকে তো অনেক খোঁজেছি, কোথায় ছিলে?
-     তোমাকে কি এমনি খালি হাতে যেতে দেব! তোমার জন্য একটা গীফট্‌ নিতে গিয়েছিলাম, আর তুমি একটুও অপেক্ষা করতে পারলে না, স্টুপিড্‌।
এই বলে একটা প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে হাতটা জরিয়ে ধরল। কিছুক্ষন দুজনেই চুপচাপ হয়ে রইলাম। কিছু অজানা অনুভুতি যেন চারিদিকে জড়িয়ে ধড়েছে। ভালোবাসার মিষ্টি গন্ধ যেন বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। ধ্যানভগ্ন ঘটলো নাইটসুপারের হর্নের আওয়াজে। সুপার যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। তানিয়াও হাতটা ছেরে দিল। আমি বললাম তুমি এখন ঘরে যাও। এখান থেকে ভাঙ্গাগড় যেতে সময়ও লাগবে। সাবধানে যেও।
তানিয়া আর কিছুই বলল না। শুধু শেষবারে মত একবার আমার দিকে তাকিয়ে চলে গেল। আর আমিও বাসে উঠে বসে পরলাম। হাতের গীফট্‌টা আর না দেখেই ব্যাগে ঢুকিয়ে দিলাম।
পরের দিন সকাল ১০টা। জাস্ট ঘরে এসে ঢুকেছি। গুয়াহাটি-শিলচর রাস্তা এমনিতেই আদীমযুগের যাতায়াত ব্যবস্থাকেও হার মানিয়ে দেয়। রাতের ধকল কাটাতে তাই আগে স্নানটা সেরে নিলাম। মা চা এনে দিলেন। চাএ চুমুক দিতে দিতে চোঁখ পড়ল যুগশঙ্খ পত্রিকায়, আর নিমেষে যেন আমার পৃথিবীটা অন্ধকার হয়ে উঠলো-কাল ভাঙ্গাগড় এলাকায় এক ভয়ঙ্কর বোমা বিষ্ফোরনে একজন নিহত, আর অনেক আহত হয়েছেন। নিহত তরুনীর নাম তানিয়া চৌধুরী। খবরটা আর পড়ার আগেই কাগজটা হাত থেকে পরে গেল আর অজান্তেই চোঁখ দিয়ে জল বেরিয়ে এল। অশ্রুসজল চোখে ভেসে উঠল তানিয়ার মুখ, আর মনে পড়ল কালকের গীফট্‌ এর কথা। এখনও খোলা হয় নি। ব্যাগ থেকে প্যাকেট্‌টা বের করে রেপারটা খুলে দেখি একটা গানের সিডি। তার উপরে বড় করে লেখা আমার ভিতর বাহিরে অন্তর অন্তরে আছো তুমি, হৃদয় জুড়ে